১৫ পুলিশ হত্যায় মামলা: আ.লীগ নেতাসহ আসামি ৬ হাজার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একদিনে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ১৫ পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা ও থানা ভবনে হামলা ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ ৬ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে।

গত ২৫ আগস্ট রাতে এনায়েতপুর থানার এসআই আব্দুল মালেক বাদী হয়ে এ ঘটনার ২২ দিন পর এ মামলা দায়ের করেছেন। এনায়েতপুর থানা ভবনে হামলা ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় চার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার সকালে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এনায়েতপুর থানায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ ১৫ পুলিশকে হত্যা মামলায় এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও খুকনী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুল্লুক চাঁন, বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম ভূঁইয়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আরও অজ্ঞাত পাঁচ থেকে ছয় হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এ মামলার আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রাত-দিন কাজ করছেন।

মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা এক আসামিকে এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু ছেড়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন ওসিকে চাপ প্রয়োগ করেন। তিনি তার ওই অবৈধ দাবি মেনে না নেওয়ায় পুলিশের ওপর তার ক্ষোভ ছিল। পরে ওই আসামির বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হলে তিনি পুলিশের ওপর আরও ক্ষুব্ধ হন। পরে বাচ্চুর নেতৃত্বে ৪৫০-৫০০ জন অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারী এনায়েতপুর থানা ঘেরাও করে। তৎকালীন ওসি আব্দুর রাজ্জাকের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন। পরে আসামিরা এনায়েতপুর থানা পুলিশের ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। গত ৪ আগস্ট দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা এনায়েতপুর থানার সামনে বিক্ষোভ করে। এ সময় ওসি আব্দুর রাজ্জাক হ্যান্ডমাইক দিয়ে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।

তখন ওসি রাজ্জাক বলেন, এই থানা সাধারণ জনগণের। আপনারা থানার কোনো ক্ষয়ক্ষতি করবেন না। এ কথায় ছাত্র-জনতারা চলে যান। পরে ১নং আসামি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চুর নেতৃত্বে এজাহার নামীয় আসামিসহ পাঁচ থেকে ছয় হাজার দুষ্কৃতকারী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে থানায় হামলা চালায়। আত্মরক্ষায় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। আসামিরা পুলিশের কোয়ার্টার ও ওসির বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন দেখে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

আসামিরা থানা কম্পাউন্ডে এসআই তহছেনুজ্জামান, এএসআই ওবায়দুর রহমান, কনস্টেবল আরিফুল আজম, রবিউল আলম শাহ, হাফিজুল ইসলাম, শাহিন, রিয়াজুল ইসলামকে পিটিয়ে ও ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। একপর্যায়ে আসামিরা থানা ভবন ধ্বংস ও জীবিত পুলিশ সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে ভেতরে ঢুকে যায়। পুলিশের ও জনসাধারণের জমা দেওয়া বেসরকারি অস্ত্র ও গুলি লুট করে। পরে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে থানার ভেতর ও বাইরে থাকা অফিসার ও ফোর্সকে এলোপাতাড়ি গুলি করে।

এ সময় থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক, এসআই আনিছুর রহমান, এসআই রহিজ উদ্দিন খান, এসআই প্রণবেশ কুমার বিশ্বাস, কনস্টেবল আব্দুল সালেক ও কনস্টেবল হানিফ আলী থানার পাশে বাবু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। আসামিরা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সেখানে গিয়ে তাদের পিটিয়ে ও কুপিয়ে ১৩ জনকে হত্যা করে। এ সময় নারী কনস্টেবল রেহেনা পারভীনকে মারধর করে টানাহেঁচড়া করে শ্লীলতাহানি করে। পরবর্তীতে বিকালে সেনাবাহিনীর একটি দল থানা এলাকায় পৌঁছে নিহত পুলিশ সদস্যদের মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

এছাড়া রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চিকিৎসাধীন এনায়েতপুর থানার আহত আরও দুই পুলিশ নিহত হন। তারা হলেন- চাটমোহর উপজেলার মাঝগ্রামের নবির উদ্দিনের ছেলে এসআই নাজমুল ও পাবনার ফরিদপুর উপজেলার রামনগর গ্রামের কনস্টেবল হুমায়ুন কবির। ফলে মোট ১৫ জন পুলিশ নিহতর ঘটনায় এ মামলা দায়ের করা হয়।

আসামিরা পাঁচটি পিস্তল ও আটটি ম্যাগজিন, একটি চায়না পিস্তল ও দুইটি ম্যাগজিন, চারটি চায়না রাইফেল ও ৩৭টি চার্জার, দুইটি চায়না রাইফেল টাইপ ও দুইটি ম্যাগজিন, ছয়টি ১২ বোর শটগান, একটি ৩৮ মিমি গ্যাসগান লঞ্চার, ৭.৬২/৩৯ মিমি গুলি ১৬৮ রাউন্ড, ৭.৬২/২৫ মিমি গুলি ১৬ রাউন্ড, ৯/১৯ মিমি গুলি ৬০ রাউন্ড, ১২ রোব শটগান (রাবার কার্তুজ) ২২৭ রাউন্ড, ১২ রোব শটগান (লেটবল কার্তুজ) ৩৫৯ রাউন্ড, লং রেঞ্জ গ্যাস শেল ৩৮ রাউন্ড, শর্ট রেঞ্জ গ্যাস শেল ৩৬ রাউন্ড লুট করে নিয়ে যায়।

এছাড়া আসামিরা একটি ডাবল কেবিন ও একটি সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ ভ্যান, পুলিশ সদস্যদের ১৫টি মোটরসাইকেল ও একটি ট্রাক, বিভিন্ন সময় আটক করা নতুন ও পুরাতন ১২টি মোটরসাইকেল ও থানার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি, আসবাবপত্র, কম্পিউটার, ওয়াকিটকি পুড়িয়ে দেয়। এতে এনায়েতপুর থানার চার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

এনায়েতপুর থানার ওসি হাসিবুল্লাহ হাসিব ১৫ পুলিশ হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এ মামলার কোনো আসামি এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। এছাড়া লুট হওয়া অস্ত্রও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে আসামিদের গ্রেফতার ও লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *